প্রকাশিত: Mon, Jan 9, 2023 8:50 AM
আপডেট: Sun, Jun 29, 2025 3:29 AM

কাওয়ালী, ছেমা মাহফিল এবং সালাফী ইসলামের প্রসার

বাতেন মোহাম্মদ

হাটহাজারীর কাটিরহাট বাজার থেকে পশ্চিম ধলইয়ের দিকে যাচ্ছিলাম সিএনজিতে। ড্রাইভার শফি ভাইয়ের সঙ্গে টুকটাক কথা বলছিলাম। হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশের মাঠে বিশাল প্যান্ডেল। বড় বড় ডেকচিতে রান্না হচ্ছে। শফি ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, কইত্তারোন্না কী ওদ্দে এ জাগাত (বলতে পারেন, কী হচ্ছে এখানে)। মাহফিল ওইত্তারে, শফি ভাই উত্তর দিলো। আমি কিছুটা বিস্ময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এত্তর প্যান্ডেল, ক’আজার  মানুষ অইবো? শফি ভাই নির্লিপ্তভাবে উত্তর, ১০-১২ হাজার অইবুদে আরি। ইবা ছোড মইক্কা মাহফিল। আরার বাড়ির ঘাটাত গত হুক্কুরবারত ১০ গরুর মাহফিল অইয়্য। কাসেম ইছাপুরী সাব আইস্যে। কাওয়ালী চইল্যে হারারাইত। মন্নান কাওয়াল জমাই ফালাইয়ে। (১০-১২ হাজার মানুষ হতে পারে। এটা ছোট মাহফিল। আমার বাড়ির সামনে গত শুক্রবারে এর থেকে বড় মাহফিল হইছে। ১০ গরু জবেহ করে খাওয়াইছে। কাছেম ইছাপুরী সাহেব এসেছিলো ওয়াজ করতে। সারারাত কাওয়ালীর আসর জমেছিলো। মন্নান কাওয়াল জমিয়ে রেখেছিলো) কিছুটা উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, অনারার ইক্কা কাওয়ালী ওয় নিকি মাহফিলত (আপনাদের এদিকে মাহফিলে কাওয়ালী হয়?)। শফি ভাই বিশাল আগ্রহ বলতে লাগলো, ও মানি! ছেমা মাহফিল কাওয়ালী ছাড়া মানুষ যাইবোনা? আরার উত্তর চিটাগাং ত কাওয়ালী ছাড়া মানুষ মাহফিলত যাইতো ন চায়। কাওয়ালী আর মেজবান অইদ্দে আরার এলাখার ঐতিহ্য। (হয় মানে? মাহফিলে কাওয়ালী ছাড়া মানুষ যাবে? আমাদের উত্তর চট্টগ্রামে কাওয়ালী ছাড়া মানুষ মাহফিলে যেতে চায় না। কাওয়ালী আর মেজবান আমাদের এলাকার ঐতিহ্য) কাওয়ালী নিয়ে আরেকটু জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কোন কোন কাওয়ালী শিল্পীর এখন কদর বেশি? শফি ভাই জানালো, ‘মন্নান কাওয়ালের ডিমান এহন বেশি। 

একেক পোগ্রাম কইত্তে ১২-১৫ আজার টেয়া চার্জ ঘরে। তবে বেজ্ঞুনেত্তন বড় আছিল গফুর হালি’। ইতে মরি যাইবার পর মন্নান কাওয়ালত্তে ডিমান বাইজ্জে। আগে ইতা গফুর হালির দলে বাজাইতু। ইতা ছাড়াও শাহজাহান কাওয়াল আছে, রশিদ কাওয়াল আছে। ইতারার ডিমান অইয়্যেদে ৮-১০ আজার টিয়া। এক নাগাড়ে বলে শফি ভাই একটু দম নিচ্ছিলো। ইতমধ্যে আমি আমার  গন্তব্যে চলে আসলাম। শীতকাল মানেই বাঙালির শহরে কিংবা গ্রামে ওয়াজ, মেলার মেলা বসে। তবে উত্তর চট্টগ্রামের ঐতিহ্য হচ্ছে এই ছেমা মাহফিল। এই ধরনের মাহফিলে ওয়াজ নসিহতের সঙ্গে ভক্তিমুলক গান পরিবেশন করা হয়। মূলত ফটিকছড়ির মাইজভান্ডার শরীফের প্রভাবে এই অঞ্চলে কাওয়ালীর ব্যাপক কদর। শফি ভাই ঠিকই বলেছে, গফুর হালী কিংবদন্তি কাওয়াল শিল্পী। অনেক গানের স্রষ্টা। এছাড়াও ছিলো কবিয়াল রমেশ শীল। বর্তমানে মন্নান কাওয়াল, শাহজাহান কাওয়ালের ভালো নাম ডাক আছে। তবে কাওয়ালীর মধ্যে নানা ঘরানা আছে। চিশতীয়া, কাদেরিয়া মূলত প্রধান দুইটা ঘরানা। কাওয়ালী একধরনের সুফী গানের ধারা। সুফির চারটা প্রধান ধারা সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায়। চিশতীয়া, কাদেরিয়া, সোহরাওয়ার্দী ও নকশবন্দী। তবে আমাদের দেশে চিশতীয়া (খাজা মইনুদ্দিন চিশতী যিনি খাজা গরীবে নেওয়াজ নামেই সমধিক পরিচিত) তরিকার অনুসরণকারী বেশি। কাদেরিয়া তরিকার অনুসরণকারীদের মধ্যে উত্তর চট্টগ্রামের মাইজভান্ডার বিখ্যাত। এই মাইজভান্ডারের কল্যাণে উত্তর চট্টগ্রামে কাদেরিয়া তরিকার অনুসরণকারী ব্যাপক। রাউজানের কাগতিয়া শরীফের ব্যাপক অনুসারী আছে। মুনিরিয়া তরিকত নামে পরিচিত হলেও এরাও মূলত কাদেরিয়া সুফী ঘরানার। সোহরাওয়ার্দী ও নকশবন্দী তরিকা অনুসারী বাংলাদেশে তুলনামুলক কম। 

সুফী ধারায় নানা ধারা থাকলেও তাদের মধ্যে খুব একটা বিবাদ দেখা যায় না। তাদের মৌলিক বিষয় আশয়ে খুব একটা বিরোধ দেখা যায়নি। তবে এই ধারাগুলোর একটা প্রধান অনুসঙ্গ সংগীত কিংবা সুরের মাধ্যমে স্রষ্টার দিদার লাভ করার চেষ্টা। হালকায়ে জিকির, ছেমা মাহফিল, দুরুদ এই ধরনের নানা ক্রিয়া কর্মে সংগীত, সুর একটা বিশাল জায়গা দখল করে আছে। এটা শুধু একধরনের মাইস্টিক রুট নয়, এটার বিশাল সাংস্কৃতিক মূল্য আছে। যদিও কাওয়ালী গান কিংবা সুফী সংগীতে পারসিয়ান একধরনের প্রভাব আছে তবে কালের বিবর্তনে এটা আমাদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র হারমোনিয়া ও তবলার সঙ্গে ভালোই সিংক করে একান্তই আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসাবে দাঁড়িয়ে গেছে। উপমহাদেশে কাওয়ালী বলতেই কিংবদন্তি ওস্তাদ নুসরাত ফতেহ আলী খানের নাম আসে। সমগ্র বিশ্বে কাওয়ালীকে সংগীতের একটা জনরা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান অবিস্মরণীয়। তারপরেই আসবে আরেক কিংবদন্তি আবিদা পারভীনের নাম। কাওয়ালী গানের উৎপত্তি কোথা থেকে হয়েছে সেটা নিয়ে বিতর্ক থাকলেও অনেকে পাকিস্তানে অবস্থিত শেখ ফরিদের মাজারে উপমহাদেশে কাওয়ালীর প্রথম চর্চা হয় বলে মত দেয় (বজরংগী ভাইজান মুভীতে শেখ ফরিদের মাজারে একটা কাওয়ালী গানের দৃশ্য দেখানো হয়, যেখানে আদনান সামীকে দেখানো হয় কাওয়ালী গাচ্ছিলো। তবে নিশ্চিতভাবে কাওয়ালী একটা স্বতন্ত্র ও শক্তিশালী ধারা হিসাবে দাড়িয়েছে আজমীর শরিফকে কেন্দ্র করে। 

রকস্টার মুভীর সেইসব দৃশ্যের কথা মনে আছে? যেখানে রনবীর কাপুর কিভাবে আজমীর শরীফে গিয়ে তার ভেতরের আধ্যাত্মিকতাকে জাগিয়ে তোলে, খাজা বাবার ভক্তিমূলক গানের তালে তালে স্রষ্টার কাছে নিবেদন করে নিজের ভেতরের দুঃখ। উপমহাদেশে চিশতীয়া কিংবা খাজা বাবার তরিকার কাওয়ালী বেশি জনপ্রিয়। বাংলাদেশে চিশতীয়া তরিকার বিখ্যাত কাওয়াল সেলিম নিজামী। মনে পড়লো, আমাদের এলাকায় ছোট বেলায় শীতকালে এই ধরনের কাওয়ালী হতো। কলোনীর সব বাসা থেকে মুঠ চাল কিংবা টাকা চাদা তুলে এ-ব্লক বাদাম গাছ তলে সারারাত কাওয়ালী ছন্দে আমরা ঢুলতাম। ভোর রাতের দিকে শুরু হতো হালকায়ে জিকির- আল্লাহু আল্লাহু- আল্লাহু জিকিরের তালে তালে আমরা ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম। তারপর ফজরের নামাজ শেষে হতো তবারক বিতরণ। আমরা যারা ছোট তারা একবার তবারক ( আখনি বিরিয়ানী) খেয়ে মিথ্যা বলে আবার লাইনে দাড়াতাম। বাসায় বাসায় মা বোনদের জন্য ও তবারক দিয়ে যেত।

অনেক বছর এখন সেসব হয় না। শুনেছি এইসব নিয়ে নানা ফেরকা আছে। নানা ফতোয়া আছে। কেউ কেউ বেদাত বলে এইসব কে খারিজ করে। কেউ কেউতো সরাসরি শিরক হিসাবে ফতোয়া দেয়। এইসব নিয়ে এলাকায় নাকি মারামারিও হয়েছিলো। মূলত বিহারী ও কিছু সুফীধারার লোক ছিলো এইগুলোর পৃষ্ঠপোষক। রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় সালাফী ইসলামের প্রসার ঘটার সঙ্গে সঙ্গে এইসব কাওয়ালী, ছেমা মাহফিলের পরিমাণ কমতে লাগলো। এখন শহরে হয় না বললেই চলে। তবে এখনো উত্তর চট্টগ্রামে এই কাওয়ালীর ঐতিহ্য ধরে রেখেছে। ধর্মীয় ব্যাখা যাই হোক, এই কাওয়ালী আমাদের ঐতিহ্য। আমাদের  সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এই ঐতিহ্য ছাড়া চট্টগ্রামকে কল্পনা করা যায় না। ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতাছে নুরের খেলা, নুরী মওলা বসাইল প্রেমের মেলা। আল্লাহু আল্লাহু রবে নানান বাদ্য শুনা যায়, গাউছুল আজম নাম শুনিলে আশেকগণে হুশ হারায়’। (গফুর হালী)। ফেসবুক থেকে